সোহেল রানা ॥
সাজেদা বেগম ১৯৩৭ সালের ১৬ মার্চ রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলার বালিয়াকান্দি ইউনিয়নের নিশ্চিন্তপুর গ্রামের দরিদ্র সাধারণ কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। পরিবারের ৩ বোন ১ ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন ২য়। তার পিতা ছিলেন সাধারণ কৃষক। যার কারণে ৮ম শ্রেণিতে লেখাপড়া চলাকালীন সময়ে তাকে বালিয়াকান্দি উপজেলার বহরপুর ইউনিয়নের মৃত সোনাউল্লাহ মন্ডলের ৬ষ্ঠ পুত্র আরশেদ আলীর সাথে বিয়ে দিয়ে দেন।
সেখানেও নুন আনতে পান্তা ফুড়ায়। স্বামী ছিলেন যৌথ পরিবারের ৮ম সন্তানের মধ্যে ৬ষ্ঠ সন্তান। তার স্বামীর বয়স যখন ছয় বছর তখন মারা যান বাবা। চৌচালা একটি ছোনের ঘরে যৌথ ছিল সংসার। যার কারণে ওই পরিবারের কোন শৃংখলা ছিল না। স্বামী এসএসসি পাশ বেকার, সামান্য জমি, আয় নেই, পরিবারের সদস্য বেশী হওয়ায় পিতার পরিবার থেকে যেন আরও কষ্ট বেড়ে যায় শ্বশুর বাড়ীতে এসে।
এরপর ১৯৬৮ সালে জামালপুর ইউনিয়নের বেতাঙ্গা বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৬০ টাকা বেতনে সহকারী শিক্ষক হিসেবে চাকুরীতে প্রবেশ করে তার স্বামী। ওই বছরই তাদের ঘর আলো করে ১ম কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। তার নাম রাখা হয় চাঁদ সুলতানা। চিন্তা আকাশ ছোঁয়া। কিভাবে তাকে বড় করে মানুষ করে তুলবে। স্বামীর স্বপ্ন যেভাবেই চলুক আমাদের সংসার, অন্তত সন্তানকে মানুষের মত মানুষ করে গড়ে তুলতে হবে, হতে হবে শিক্ষিত।
পরবর্তীতে ১৯৭০ সালে জন্ম নেয় একটি পুত্র সন্তান নাম রাখেন মোঃ নাসির উদ্দিন। তাদের সংসারে যখন সদস্য বেড়ে যায় তখন যৌথ পরিবার থেকে আলাদা হতে হয়। ২ সন্তানসহ ৪ জনে তাদের আলাদা সংসার। ১৯৭৩ সালে স্বামীর কর্মরত বিদ্যালয়টি জাতীয়করণ হয়। জীবনে একটু আলো দেখতে পান। বিদ্যালয়টি জাতীয়করণের পর বেতন বৃদ্ধি পেয়ে ৩০০ টাকা বেতন পেতে থাকে। এ অর্থনৈতিক দৈন্যতার মধ্যেও কোন কমতি ছিল না ২টি সন্তানের লেখাপড়ার।
দু,জনে মিলে কঠোর পরিশ্রম করে দিনে স্কুল শেষ করে রাতে ঘর তৈরির জন্য মাটি কাটতে থাকেন। এক সময় তৈরি করে ফেলেন একটি ভিটা। সেখানেই চৌচালা একটি টিনের ঘর নির্মাণ করেন। সবে মাত্র একটু একটু করে চলা শুরু। পর্যায়ক্রমে ১৯৮৩ সালে ছোট ছেলে নাজমুল হাসানের জন্ম হয়। তখন তাদের ৪ মেয়ে ও ৩ ছেলেসহ পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৯জন। বড় মেয়ে এইচএসসিতে অধ্যায়নরত। একে একে সবাইকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করার তাগিদে স্বামীর আয় থেকে বাড়তি আয়ের জন্য হাঁস-মুরগী পালন, গাভী পালন, বাড়ীর আঙিনায় সব্জী চাষ শুরু করেন।
স্বামীর আয় আর বাড়তি আয়ে সন্তানদেরকে কোন কমতি রাখেন না শিক্ষার ক্ষেত্রে। বাড়ীর কাজ করার পর প্রতিটি সন্তানকে রাত জেগে পড়াতেন তার স্বামী। তার যেন দম ফেলানোর সময় নেই। প্রতিটি সময় থাকতে হতো সন্তানদের লেখাপড়া করানোর জন্য তাকে।
এত কষ্টের মধ্যেও বর্তমানে বড় সন্তান চাঁদ সুলতানা বালিয়াকান্দি মডেল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এবং তিন ছেলেই কানাডা প্রবাসী। ২য় সন্তান অধ্যাপক ড. মোঃ নাসির উদ্দিন এইচএসসি পরীক্ষায় ১৯৮৬ সালে বালিয়াকান্দি কলেজ থেকে স্টারমার্ক প্রাপ্ত হওয়ার দরুন কলেজ কর্তৃপক্ষ তাকে স্বর্ণপদক প্রদান করেন। সে বুয়েটে তড়িৎ বিভাগে ১ম শ্রেণিতে ২য় স্থান অধিকার করা বুয়েটের শিক্ষক হন। পরে কানাডিয়ান কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন এবং বর্তমানে কানাডা লেকহেড বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ কৌশল বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন। ৩য় সন্তান ছালমা পারভীন, গৃহিনী, ৪র্থ সন্তান জাহানারা পারভীন, রাজবাড়ী রামকান্তপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক, ৫ম সন্তান সুলতানা রাজিয়া, বর্তমানে তাদের নিজের প্রতিষ্ঠিত আরশেদ-সাজেদা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক।
৬ষ্ঠ এবং ৭ম ছেলে কানাডায় সুপ্রতিষ্ঠিত একটি কোম্পানীতে চাকুরীরত আছে। চার জামাতার দুইজন কলেজ শিক্ষক, একজন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অবসরপ্রাপ্ত এবং অন্যজন কলেজ কম্পিউটার অপারেটর হিসাবে চাকুরীরত আছেন। তার এবং স্বামীর স্বপ্ন ছিল যেমন সন্তানদেরকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করার। আবার পাশাপাশি তার স্বপ্ন ছিল এ এলাকার শিক্ষার উন্নয়ন ঘটানোর।
এরই ধারাবাহিকতায় তার ছেলে ড. মোঃ নাসির উদ্দিনের সহযোগিতায় নিজের জায়গায় এ এলাকার পিছিয়ে পড়া জনপদের কোমলমতি শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য ২০০৫ সালে নিজের জমিতে নিজ অর্থায়নে আরশেদ সাজেদা বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় নামে একটি বিদ্যালয় স্থাপন করেন।
যে বিদ্যালয়টির সমস্ত খরচ তার বড় ছেলে ড. নাসির উদ্দিন বহন করেছে, শুধু তাই নয় কোন প্রকার ফি ছাড়াই সকল শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া নিশ্চিত করেছেন।
বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে ২০১১ সাল থেকে বিদ্যালয়টিতে কম্পিউটারের ব্যবস্থা করেছেন। যে বিদ্যালয়টি জননেত্রী শেখ হাসিনার ২০১৩ সালের ঘোষনায় সরকারীকরণ করা হয়েছে। এলাকার ধর্মভীরুদের কথা চিন্তা করে তার বড় ছেলে গোহাইলবাড়ী গ্রামে একটি মসজিদও প্রতিষ্ঠা করেছেন। যেটির দেখভাল তার স্বামী করতেন।
তিনি সম্প্রতি ইন্তেকাল করেছেন বর্তমান তিনিই সবকিছুর দেখাশুনা চালিয়ে যাচ্ছি। এ মহিয়সী নারী সাজেদা বেগমকে শনিবার রাজবাড়ী জেলা ও বালিয়াকান্দি উপজেলা প্রশাসন আয়োজিত আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ ও বেগম রোকেয়া দিবস উদযাপন উপলক্ষে জয়িতা অন্বেষনে বাংলাদেশ সফল জয়িতাকে সম্মাননা প্রদান করেছেন।