সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী পরিচালিত ডুব চলচ্চিত্রটির ট্রেলার। ট্রেলার মুক্তির সাথে সাথেই, আগে থেকে চলতে থাকা বিতর্কটি আবারও সামনে এসেছে। এ ছবি কি হুমায়ুন আহমেদের জীবন অবলম্বনে নির্মিত?
বরাবরই পরিচালক ফারুকী তা অস্বীকার করে এসেছেন। তবে ট্রেলারটি দেখার পরে অনেকেই সেখানে হুমায়ুন আহমেদের জীবনের নানা অংশ খুঁজে পেয়েছেন। বাংলাদেশে দ্বিতীয় বিবাহ অস্বাভাবিক কিছু না। এবং মধ্যবিত্তের জীবন-যাপন প্রক্রিয়ায় থাকে অদ্ভুত মিল। ফলে কোন ব্যক্তি যদি বলে এটা হুমায়ুন আহমেদের জীবন নয়, বরং সেই ব্যক্তির জীবন থেকে অবলম্বন করে নির্মিত, তাহলেও আমি অবাক হব না। বরং সেটাই আমার কাছে স্বাভাবিক মনে হবে। কিন্তু যদি ধরেও নেই যে ডুব মূলত হুমায়ুন আহমেদের জীবনের ছায়া অবলম্বনে (পুরোপুরি নয়, কারণ ট্রেলারে অনেক কিছুই হুমায়ুন আহমেদের সাথে মেলে না) নির্মিত, তাতেও আসলে কোন সমস্যা থাকে না।
এমনকি ডুব ছবিতে যদি হুমায়ুন আহমেদের জীবনের সাথে সাংঘাতিক মিল থাকে, চরিত্রদের নামেও যদি মিল থাকে এবং পরিচালক বা কাহিনীকার যদি বলেন যে তা না, তাহলে না। এবং থাকা সত্ত্বেও না বললেও তিনি খারাপ বা ছোট হয়ে যান না।
হুমায়ুন আহমেদের বই পড়লে এবং তার পারিপার্শিক অবস্থা বিবেচনা করলে, দেখা যায় হুমায়ুন আহমেদ নিজেই অনেক সত্যিকারের চরিত্র নিয়ে গল্প লিখেছেন। তাকে যেমন স্বীকার করতে হয়নি যে হিমু মূলত নীললোহিতের ছায়া অবলম্বনে রচিত সেরকম কারোরই স্বীকার করতে হয় না আসলে। জাফর ইকবালের সায়েন্স ফিকশন মূলত ইংরেজি সায়েন্স ম্যাগাজিনের গল্পগুলোর ছায়া থেকে বানানো এলাবোরেট ভার্শন। এমনকি হুমায়ুন আহমেদের সায়েন্স ফিকশনগুলোও। যা সরাসরি অনুবাদ নয়, যেখানে অনেক কিছুই আলাদা কিন্তু গল্পটার এসেন্স হয়তো এক। ফলে তা ছায়া অবলম্বনও নয়। আহমেদ ছফার পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ, অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী খুলেন। পড়লেই বুঝতে পারবেন এখানে বাস্তব চরিত্র দিয়ে ভরপুর। বা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘যুবক যুবতী’, সেখানেও রয়েছে বাস্তব চরিত্রের নানা রকম স্বীকারোক্তিমূলক কার্যকলাপ। কিন্তু নাম পরিবর্তন করার কারণে তা আর ছায়া অবলম্বন বা নকল বা চুরি হলো না। আরেকটা কথা, আর্ট সত্য মিথ্যার কেয়ার করে না। ন্যারেটিভতো না-ই! ইয়াহিয়ার চরিত্র বানাতে গেলে তা স্বীকার করে কেন নিতে হবে! বা রাজাকারদের চরিত্র? ফারুকীর ৪২০ নাটকে কোন এমপি থেকে গল্প ধার করেছেন, বা মেইড ইন বাংলাদেশে যেসব চরিত্র আমরা দেখেছি তারা কারা, তা বলতে হয়েছে কি?
সম্প্রতি যে হরর মুভিটা বের হলো, ‘ইট’- যা ম্যানহোলের মধ্যে থেকে তাণ্ডব চালায়, তা মূলত কাউন্টার কালচার বেসড একটা ম্যাগাজিনের আডাপশান। এই ম্যাগাজিন আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে বের হতো এবং তরুণ-তরুণীদের পজেজ করত হিপ্পি হতে, পাবলিক ফিয়ারে পরিনত হয়েছিল এই ম্যাগ, সেই ফিয়ার নিয়ে ছদ্মনামে স্টিফেন কিং গল্পটা লিখেন, কিন্তু রাইটারকে ছায়া অবলম্বন বলতে হয়নি।
ঋতুপর্ন ঘোষের আবহমান ছবিতে কতটুকু সত্যজিৎ আছে তা স্বীকার করতে হয়নি, ঋতু খারাপও হননি তাতে। বা, সত্যজিৎ এর নায়ক ছবিতে মূল চরিত্রে কোন নায়ক আছেন তা স্বীকার করতে হয়নি। এটা লেখকের প্রাইভেসি।
প্রশ্ন থাকতে পারে, কিছু মিল থাকা সত্ত্বেও ফারুকি কেন অস্বীকার করলেন। কেন বললেন যে এখানে হুমায়ুন আহমেদ নেই!
যদি তিনি বলতেন (বলতেই পারতেন, বললেই লাভ বেশী) এটা হুমায়ুন আহমেদ থেকে নেয়া, তাহলে তিনি তার শৈল্পিক স্বাধীনতা হারাতেন। গল্পটাকে হুমায়ুন আহমেদের জীবনের মতোই হতে হতো। কোন কিছু বদলে দিলে, বা গল্পের খাতিরে যোগ করলে, সিনেমাটিক এক্সপ্রেশান আনার খাতিরে নতুন চরিত্র আনলে, বা পরিচালকের জীবন সম্পর্কিত পারসেপশেনে ঘটনাগুলোকে দেখলে, ড্রামাটিক করার জন্য চরিত্রদের আচার-আচরণ বদলালে, ইতিবাচকতা-নেতিবাচকতায় পরিচালকের নিজস্ব চিন্তা ঢুকালে, গল্পের টোন ঠিক রাখার জন্য বিভিন্ন বিষয় এড়িয়ে গেলে তা আরও সমস্যার তৈরী করতো। তা হুমায়ুন আহমেদের ভক্তদের আরও ব্যথা দিত।
নৈতিকভাবে ফারুকী কোন ভুল করলেন কি?
অনেকে হয়তো এই ছবি দেখে হুমায়ুন আহমেদের সাথে মিল পাবেন। তার সম্পর্কে ধারণা বদলে যাবে। কেউ কেউ আঘাত পেতে পারেন। কিন্তু তাতে ফারুকির কোন দোষ নেই। টেলিভিশন বা ইন্টারনেটও মানুষের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু যা আপনি নিজে থেকে বাদ দিতে পারেন, বা আপনি চাইলে যা থেকে দূরে থাকতে পারেন- আর তা থেকে যে ক্ষতি তার দায় আসলে আপনারই।
ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য আছে এখানে বা স্টান্টবাজি?
সিনেমার যে বিজনেস হয়, তার খুব সামান্যই পান পরিচালক। এটা মূলত যৌথ প্রযোজনার ছবি। মনে হয় না এখানে কোন ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু যদি এই ইস্যুর কারণে ব্যবসা বাড়ে তাতে সমস্যা তো নেই! বরং তাই ভালো। (বর্তমানে আমাদের সিনেমাশিল্পের কথা বিবেচনায় নিয়ে)
এরকম গল্প নির্মাণ করার স্বাধীনতা!
আপনি যদি সিনেমা সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখেন, তাহলে খেয়াল করবেন এই বিষয়টা সিনেমা ইতিহাসে নতুন নয়। এই বিষয়ক তর্ক ফ্রান্স-আমেরিকাতে বহু আগেই হয়ে গেছে। সিনেমা সবসময় সত্যকে অনুসরন করে না। সম্পুর্ন মিথ্যা বিষয় নিয়ে সিনেমা হতে পারে। তাই নিয়ে সিনেমা হতে পারে যা আপনি বিশ্বাস করেন না, যা কখনো ঘটে নাই, যা অবৈজ্ঞানিক, যা অযৌক্তিক যা ক্ষতিকর, তা নিয়েও। সিনেমা ট্যাবু ভেঙ্গে দিতে পারে, নিষিদ্ধ বিষয়কে হাইলাইট করতে পারে, অপরাধীকে মহৎ করে দেখাতে পারে, আবার প্রচলিত খুবই ভালো একজন ব্যক্তিকে বাজেভাবে উপস্থাপন করতে পারে।
এটা আর্টের স্বাধীনতা। এটা আর্টিস্টের ফ্রিডম অফ স্পিচ। তবে এই ৫৭ ধারার বাংলাদেশে এরকম সাহসিকতা খুব বিরল। উন্নয়ন মানে পেট ভরা থাকা, শান্তিতে ঘুমানো, প্রযুক্তি ব্যবহার করা নয়। উন্নয়ন মানে অনেকাংশেই মানসিক উন্নয়ন, ব্যক্তি স্বাধীনতার উন্নয়ন, শিল্প স্বাধীনতার উন্নয়ন।
হুমায়ুন আহমেদের জ্যোৎস্না ও জননীর গল্প উপন্যাসের ভুমিকা থেকে কিছু অংশের কোট;
উপন্যাসে চরিত্র হিসেবে সেই সময়ের অতি গুরুত্ত্বপুর্ন কিছু চরিত্র এনেছি। এ স্বাধীনতা একজন ঔপন্যাসিকের আছে। অতি বিনয়ের সঙ্গে সেই বিখ্যাত উক্তি মনে করিয়ে দিচ্ছি- একজন লেখক যা লিখবেন, সেটাই সত্যি।